বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, বিশেষ করে সাতক্ষীরা ও খুলনা জেলা, ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ছিল ভয়াবহ রাজনৈতিক সহিংসতার অন্যতম কেন্দ্র। এই সময়কার সবচেয়ে নির্মম দমননীতি হিসেবে উঠে আসে ‘নিক্যাপিং’। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিকল্পিতভাবে তরুণদের হাঁটু লক্ষ্য করে গুলি চালাতো, যাতে তারা আজীবন পঙ্গুত্ববরণ করে। স্থানীয়দের ভাষ্য—এটি ছিল বিরোধী মতের কণ্ঠরোধ করার একটি “স্থায়ী সমাধান।”
শিবির নেতা শামছুল আলম বুলবুল এখনো হুইলচেয়ারে বসে জীবন কাটাচ্ছেন। ২০১৩ সালের এক ভোরে পুলিশ তাকে আটক করে নিয়ে যায়। তিনি জানান, “প্রথমে মারধর করলো, তারপর ফাঁকা মাঠে নিয়ে গিয়ে হাঁটুর নিচে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চিকিৎসা দেয়নি, ফলে পা কেটে ফেলতে হলো।”
একইভাবে বিএনপি নেতা আব্দুর রউফ ও তার ভাগনে রিয়াজুল ইসলাম চিরতরে অক্ষম হয়ে গেছেন। অনেক তরুণ পড়াশোনা বা জীবিকা হারিয়ে এখন ভিক্ষাবৃত্তি কিংবা অস্থায়ী শ্রমে বাধ্য।
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, নিক্যাপিং ছিল পরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। বাংলাদেশের গুম কমিশনের সদস্য নাবিলা ইদ্রিস বলেন, “নিক্যাপিং, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার সঙ্গে জড়িত সবাইকে বিচারের আওতায় আনা উচিত।”
আন্তর্জাতিক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২০১৬ সালের এক প্রতিবেদনে এ ঘটনাগুলোকে “No Right to Live” শিরোনামে তুলে ধরে। সেখানে উল্লেখ করা হয়, শত শত তরুণকে শুধু বিরোধী রাজনৈতিক মতের কারণে চিরপঙ্গু করা হয়েছে। প্রতিবেদনে ভুক্তভোগীদের বয়ান উদ্ধৃত করে বলা হয়, পুলিশ হেফাজতে নিয়ে গুলি করার পর ঘটনাকে সাজানো বন্দুকযুদ্ধ বা ‘ক্রসফায়ার’ হিসেবে চালানো হতো।
ভুক্তভোগী ও স্থানীয় সূত্রগুলো অভিযোগ করেছে—তৎকালীন সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার, জেলা প্রশাসক ও সরকারি হাসপাতালের কিছু সার্জন পর্যন্ত এ কাজে সহযোগিতা করেছেন। অনেকে এখনো অবসরে গেছেন, কেউ পদোন্নতিও পেয়েছেন। তবে এখনো কারও বিরুদ্ধে কার্যকর বিচার হয়নি।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৮৫ জন ভুক্তভোগীর নাম নথিভুক্ত হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, “নিক্যাপিং ও ক্রসফায়ারের অভিযোগ আমরা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি। ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার পাবেন।” তবে আইনি প্রক্রিয়া ধীরগতি হওয়ায় ভুক্তভোগীরা হতাশ।
জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থাগুলো বাংলাদেশ সরকারকে নিক্যাপিং বন্ধ ও স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের আহ্বান জানিয়েছিল। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে কিছু মামলা খোলা হলেও বাস্তব অগ্রগতি খুবই সীমিত। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের প্রতিবেদনে লিখেছিল—“পুলিশ ভুক্তভোগীদের চিরপঙ্গু করছে যাতে তারা আর কোনোদিন রাজপথে দাঁড়াতে না পারে।”
দশ বছর পরও ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারগুলো ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় আছেন। কেউ কেউ চিকিৎসার অভাবে আরও গুরুতর স্বাস্থ্য জটিলতায় ভুগছেন। স্থানীয় সমাজে অনেকেই এখনো কলঙ্কের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছেন, কারণ তাদের বিরুদ্ধে সাজানো মামলাগুলো ঝুলে আছে।
নিক্যাপিংয়ের ভয়াবহ স্মৃতি আজও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের গ্রাম-শহরে জীবন্ত। শত শত তরুণ যারা হাঁটতে পারতেন, খেলাধুলা করতেন বা জীবিকা নির্বাহ করতেন, তারা এখন হুইলচেয়ার বা লাঠিতে ভর দিয়ে বেঁচে আছেন। তাদের জীবনের আলো নিভে গেছে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার আগুনে। ইতিহাসে এ ঘটনাগুলো রয়ে গেছে এক কালো অধ্যায় হিসেবে, যার বিচার এখনো বাকি।